১৯৭১ সালের পলাতক কাহিনী | 1971 fugitive story

 ১৯৭১ সালের পলাতক কাহিনী | 1971 fugitive story

১৯৭১ সালের পলাতক কাহিনী | 1971 fugitive story

একাত্তরের পলাতক

জেলা সদর থেকে যাত্রা শুরু। উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গন্তব্য এমন একটি ইউনিয়ন সদরে যেখানে একটি গ্রাম্য বাজার রয়েছে। শুনেছি বাজারটি ক্রমবর্ধিষ্ণু। কেননা নদীর চিৎকরা যুব ঘেঁষা বাজারটি শহরে সবজি-তরকারি সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে মাত্র ১০ কি ১৫ বছর পূর্বে ধারে কাছের গ্রামগুলোর ধারণার বাইরেই গড়ে ওঠেছে। আমাকে বহন করা বাসটির প্রতি করুণা হয়, অথচ সে ছিল নির্দয়। স্পষ্ট বোঝা যায় রাজধানী শহর থেকে ন্যাড়ে কুকুরের মতো তাকে দূর দূর করে গ্রামে খেদিয়ে দেয়া হয়েছে। যখন তার যৌবন ছিল তখন রাজধানীর লোকেরা তাকে সদ্য আমদানি করা যুবতী বেশ্যার মতো যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে, ধর্ষণে-ঘর্ষণে মদনে তার শরীরের মাংস-হাড় একাকার করে দিয়েছে। নগরে বসবাসের লাইসেন্স হারিয়েছে সে। কেননা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পচন ধরা জরায়ু থেকে সে জীবাণুপূর্ণ কালো বর্ণ রক্তপুঁজ ঝরায়, তার নিঃশ্বাসে জীবনঘাতী রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর বিশুদ্ধ বাতাসে ।

বোঝা যায় বাসটির শেষ গন্তব্যের যাত্রীসংখ্যা খুবই কম । গ্রাম্য লোকগুলো যত্র-তত্র ওঠা-নামা করছে। এটাও ধরে নেয়া যায় যন্ত্রযানে আরোহণের বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞা নেই তাদের। গ্রাম্য ভাষায় ওরা বাসের কনডাক্টরের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্ক করে এবং নোংরা পোশাকের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দেয় বাসের ভেতর। কেউ কেউ স্বাধীনভাবেই বমি করে দেয়। পাকস্থলি থেকে যে অর্ধভুক্ত খাদ্য বাসে ছড়িয়ে পড়ে, ওখানে আটার রুটি কিংবা ভর্তা-ভাতে গলিত স্রোত থৈ থৈ করে। ভদ্রযাত্রীর সংখ্যা এখানে নগণ্য। অমার্জিত স্বভাবের গ্রাম্য স্কুল শিক্ষক, বেপারি কিংবা সদর কলেজে পড়ুয়া-যুবক-যুবতীদের উচ্চস্বরের আলাপ কিংবা মোবাইল ফোনের ভাষায় যে শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তার শতকরা ৯০ ভাগই উচ্চারণে অশুদ্ধ এবং অশ্লীল। ধরা যাক আমার পাশের সিটে বসা লোক দুটোর কথা। ওদের যাত্রা বোধকরি শেষ সীমানায়। ওরা অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে আর বিড়ি টানছে। ধোঁয়ার ব্যাপারে কোনও মাথা ব্যথা নেই। দুজনের মধ্যে একজনের বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই, বাকিজন বোধ করি চল্লিশ পেরিয়েছে সদ্য। ওদের কথার কোনও ধারাবাহিকতা নেই। রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে খোদার দুয়ার পর্যন্ত ছুটোছুটি করছে ওরা। মাঝে-মধ্যে সিনেমার নারীরাও দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ছে। প্রথম আমি ওদের আঞ্চলিক কথা উপভোগ করলেও শেষে ধৈর্য হারিয়ে বাসের ভাঙা কাঁচের ভেতর দিয়ে রাস্তার দু'ধারের গ্রাম দেখতে থাকি । আমার মনে হয় এই ধাবমান পাকাসড়ক গ্রামগুলোর কোনও উপকারের বদলে অপকারই করেছে অধিক। রাজনৈতিক দলগুলোর উন্নয়নের উপকার গ্রাম্য মানুষের জীবন-যাপনের কোনও বদল ঘটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। পাশের লোক দুটোর আলাপচারিতায় জানা যায় রিকশা, কাঠের ভ্যান আর শহরগামী মজুরদের জন্ম হচ্ছে গ্রামে। তেমনি হাঁস-মুরগি, কুকুর-বেড়াল এমনকি গ্রাম্য 'মফিজ'দের বাসের চাপায় মৃত্যুবরণের হিসাবটা তড়তড়িয়ে বাড়ছে। আমি বুঝতে পারি দুই ব্যক্তির মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তি অর্থাৎ যার মুখে চাপদাড়ি, চোখে কম দামের চশমা এবং পানখাওয়া দুঠোঁটের কোণে জমাট প্যাচকির মোটা প্রলেপ, তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। এটাও বোঝা গেল অবিবাহিত মেয়ের প্রাইমারী স্কুলে চাকরির জন্য স্থানীয় এমপি'র কাছে গিয়েছিলেন ঘুষের টাকার অঙ্কের ব্যাপারে দরকষাকষি করতে। এমনও মনে হয়, এই লোকটিই পারবে আমার উদ্দেশ্যকে সাধন করতে। যদিও প্রাপ্য নয়, তবু তাকে আমি সালাম জানিয়ে সেধে কথা জমাবার চেষ্টা করি। আমি যে রাজধানী শহরের মানুষ তা বুঝতে পেরে সিট বদল করে অতি উৎসাহে তিনি আমার পাশে এসে বসেন। তার দাড়িতে আটকে থাকা সুপারীর কণা ঝাড়তে ঝাড়তে আগ্রহের সঙ্গে বলেন, ‘আপনের মোকাম?’ ‘ঢাকা শহর’, আমি উত্তর করি ‘বুঝলাম ঢাহার টাউন, কিন্তু জন্মস্থান কোন জেলায়?’ লোকটি জানতে চায় । বোঝা যায় জেলা সম্পর্কে তার এলার্জি আছে। তাই আমি গ্রাম্য বুলিতে জবাব দেই, ‘পাকিস্তান জামানায় ঢাহার জেলার থাকলেও এহন গাজীপুর । ‘অ, গাজীপুইরা, ভাবছিলাম চিটাগাঙ্গিয়া নাকি নোয়াখাইল্যা, থাউক গা, কইতে চাই জয়দেবপুরের নামডা বদলাইয়া এরশাদ চাচায় যে গাজীপুর রাখল, তাইতে আপনেগর কী এমুন বাল ছিড়নের খান্দানী বাড়ল?’ লোকটি চোখ কটমট করে । পকেট থেকে বিড়ি তুলে আনে । এবং মাথা ঝাঁকায় ।

এবার তার সঙ্গী লোকটি পাশের সিট থেকে ফোড়ন কাটে, 'অ মাস্টার, কী চ্যাডের কতা কও তুমি জয়দেবপুরইরাগরে এরশাদ চাচা খাতনা কইরা মুসলমান বানাইছে, কামডা মন্দ অইল কী?' এবার দুজনই গলা মিলিয়ে হাসতে থাকে। ঠিক তখনই বর্ষার গর্ত হয়ে যাওয়া পাকা সড়কে বাসটি শক্ত একটা আছাড় খায়। সহযাত্রী কাত হয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ড্রাইভারকে শাসায়, 'অ ভাইভারের পুতের ঘরে নাতি, কী বালের গাড়ি চালাও? প্যাটঅলা মাগী প্যাসেঞ্জার থাকলে ত এতোক্ষণে বাসের মধ্যে বিয়াইয়া দিত । লোকটির কথায় আমিও হাসিতে যোগ দেই অন্যসহ যাত্রীদের সঙ্গে। কেবল মহিলা যাত্রীরা শাড়ি বা বোরখার তলে শরম লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে। হাসি থামিয়ে এবার আমি আসল কথায় আসি। আমি তার কাছে জানতে চাই তিনি দুলালপুর নামের গ্রামটি চিনেন কি-না। বলা মাত্রই লোকটি নিজের সিটের উপর প্রায় লাফিয়ে ওঠে, 'আরে মিয়া, কার কাছে কী জিগাইতাছেন? আম্মার কাছে খালাম্মার লাঙ্গের খবর? আমি ত দুলালপুরের কাশেম মাস্টর, কোন চুদিরপুতে আমার নাম না জানে? হ, দোষের মইধ্যে দোষ, কথায় কথায় গালি-গালাজ করি। করমু না কিলাইগ্যা কন-চাই দ্যাহি? হালা-পুঙ্গিরপুত না কইলে আইজ-কাইলকার জামানার ইসকুলের পোলাপানের মাথা ঠিক রাহন যায়? ঐ বেলাইল্যা, কতাডা হাচানা?' কাশেম মাস্টার দমবন্ধ করে এক নাগাড়ে এতোগুলো বাক্য বমি করে তার সঙ্গী বেলার মিয়ার সমর্থন চায়। বেলার মিয়া তাকে সমর্থনই কেবল জানায়নি, দু'পা এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘টাউনের সায়েব, জানবেন গই-গেরাম আর আগের লাহাইন নাই-অ? কি-অ কাহা, মিছা কইলাম?' এবার বেলালও সমর্থন চায় অজ্ঞাত কোনও বাসযাত্রীর। সবাই যখন তাকে সমর্থন করে তখনই সে উৎসাহে ফেটে পড়ে, 'গ্যাল শীতে আমাগর দুলালপুর গেরামে টাউনথিকা একদল পোলা-মাইয়া আইছিল পিকনিক করতে। বেশরম মাইয়াগুলান ভাবছিল দুলালপুরের পোলাপানগুলা মফিজ মার্কা। আর-কি-না তিন পোলায় মিললা একটা মাইয়ারে বাঁশঝড়ের জঙ্গলে কাম বানাইয়া ফ্যালাইছিল, যদি না আমাগর এই কাশেম মাস্টর না দ্যাখত!' কাশেম মাস্টার মাথা নাড়ে, যেন সে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেক কাজটি করে মহা গৌরবে অর্জন করেছে, 'মিছা না কতাটা, হাচা-ঐ। কি করমু কন?

এলাকার ইজ্জত আছে না?' এই ইজ্জতের বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলমান বাসটি থেমে যায়। এই তার শেষ গন্তব্য। একটি গ্রাম্যবাজার। বাস থেকে নেমে পড়ি আমি। সঙ্গে সব যাত্রীরা। কিন্তু কাশেম মাস্টারকে হাত ছাড়া করতে রাজি নই আমি। একটি দু'চালা টিনের চা-দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার আগমনের হেতু তাকে জানাই । পা থামিয়ে একটু ভেবে নিয়ে চোখ কুঁচকে কাশেম মাস্টার বলে, 'মজিদ বা আবদুল মজিদ নামের কোনও মুক্তিযোদ্ধা আমাগর গেরামে আছিল না।' চায়ের দোকানে বসে আমি কাশেম মাস্টারকে সব বুঝিয়ে বলি। কাশেম মাস্টার ততোক্ষণে বুঝতে পারে আমি একজন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অজানা তথ্য সংগ্রহকারী। তেত্রিশ বছর পূর্বে যে সব ঘটনা ও এলাকায় ঘটেছিল তাতেও অনেকটা যে বালির স্তর জমেছে, আমি লোকটির নানা কথার ভেতর বুঝতে পারি। ততোক্ষণে চায়ের দোকানে যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই দূর কুয়াশার স্মৃতির ভেতর সাঁতরাতে সাঁতরাতে ক্লান্ত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। কেন না মজিদ বা আবদুল মজিদ, পিতা মৃত ছমেদ আলী, গ্রাম দুলালপুর, পো: মোক্তারপুর, জেলা : ঢাকা, অধুনা নরসিংদী। সব ঠিক, কিন্তু মজিদ বা ছমেদ আলী বেঠিক । অথচ আমি জোর দিয়ে দাবি করি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই মুক্তিযোদ্ধাটিও ইতিহাসের জীবন্ত সত্য অপ্রত্যাশিত ভাবেই কাশেম মাস্টার, ফুঁসে ওঠে, 'আরে মিয়া, আপন ও দ্যাহি দুই নাম্বারি ব্যবসায় নামছেন, মুক্তিযুদ্ধের কবর-মাজারের ব্যবসা? পাইছেন কী আপনেরা? এ্যা? পীরের মাজার, নেতার মাজার, রাজনৈতিক দলের মাজার, দেশের মাজার, মাজার ব্যবসা আর কতো করবেন? পাবলিক কি আছান পাইব না?' ধৈর্যের সঙ্গে আমি মুখে হাসি টেনে বলি, 'আপনে আজাইরা চেইতা গ্যাছেন মাস্টরসাব, আমি একজন নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে চাই । মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার নিদর্শন জমা থাকব।' ‘বেবাকই বুঝলাম, কিন্তু আপনে যে-নাম কইতাছেন হেই নামের মুক্তিযোদ্ধার বালের নিশানাও নাই আমাগর গেরামে। মাত্র দুইজনই যুদ্ধে গেছিল আমগর গেরাম থাইক্যা। বদুবেপারীর পোলা মন্টু আর সায়েবালীর নাতি সুরুজালী। মন্টু স্বাধীনের পরে গণবাহিনী কইরা গুলি খাইয়া মরছে, জিন্দা আছে সুরুইজ্যা, হেয় অহন ইসলামী দলে ভিড়া গ্যাছে।' 

চায়ের দোকানের লোকগুলোর চোখে চোখ রেখে কাশেম মাস্টার দীর্ঘ বয়ান শেষ করে বলে, 'কি-অ, মিছা কইলাম?' আমার মনে খানিকটা ধাক্কা লাগে। তবে কি নাম-ঠিকানাটা ভুয়া? কিন্তু যে মৃত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আমাকে আবদুল মজিদের যুদ্ধের নিদর্শন দিয়েছে তার সাক্ষ্য কি মিথ্যা? ছেলেটি তার পিতার কাছে শুনেছে মজিদের বিবরণ। মজিদ ছিল তার পিতার সহযোদ্ধা। আখাউড়া বর্ডারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয় মজিদ । মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে এঁটে ওঠতে না পেরে কৌশলগত কারণে পিছু হটে আসার সময় মজিদের আহত রক্তাক্ত দেহটি বয়ে নিয়ে আসে সীমান্তের ওপারে। ক্যাম্পে দু'দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। মৃত্যুর পূর্বে মজিদ তার সহযোদ্ধাদের কাছে বলেছিল, সে নাকি অজ্ঞাত কোনও জঘন্য অপরাধ করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। মজিদ অনুরোধ করেছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং মৃত্যুর বিষয়টি যেন গোপন থাকে, কোনওদিনই গ্রামের লোক কিংবা তার আপনজনেরাও জানতে না পারে। প্রকৃত অর্থে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই আত্মগোপনে পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে, এই তাড়নাটাই ছিল আমার আগ্রহের বিষয়। তেত্রিশ বছর পর আবিষ্কৃত, বলতে গেলে অপ্রত্যাশিতভাবেই এই অজানা রহস্য আমাকে টেনে আনে এই গ্রামে। চায়ের দোকানে ছিন্নভিন্ন হতে

হতে আমি আমার হাতব্যাগ থেকে তুলে নেই মুক্তিযোদ্ধা মজিদের যুদ্ধের পরিচয়পত্র। তেত্রিশ বছরের পুরানো ছবি আঁটা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পরিচয় পত্রটি আমার হাতে কেঁপে ওঠে। এক যুবকের প্রতিকৃতি। চারপাশ ঘোলাটে অস্পষ্ট, দাগপড়া, কিন্তু যুবকের চোখজোড়া অক্ষত ঝলমলে। নির্বাক তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। দৃষ্টি প্রত্যাশা শূন্য। সেপ্টেম্বর দশ, উনিশ শ' একাত্তর। সীলমোহরের অক্ষরগুলো যেনো জীবন্ত।

‘আপনি কি এই ছেলেটার চিনেন?' জীর্ণ পরিচয়পত্রটি আমি তুলে ধরি কাশেম মাস্টারের সামনে।পাথরের মতো ঠাণ্ডা এবং জমাট কঠিন দৃষ্টি ফেলে কাশেম মাস্টার কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন ছবিটির দিকে। আচমকা লোকটি প্রায় চিৎকার করে ওঠে এই বলে, ‘এ্যাই ফটু আপনে পাইলেন কৈ? এ্যাইডা ত আকবর আলীর পোলা শাজাহানের। এ্যাই বদমাইশটা করছিল কী জানেন?' কথার মাঝখানে কাশেম মাস্টার থেমে গেলে চায়ের দোকানের লোকেরা হুমড়ি খেযে পড়ে টেবিলে । বয়স্করা আর্তনাদের আওয়াজ গলায় তুলে আনলেও যুবকেরা নিশ্চুপ। তখনই কাশেম মাস্টার পুনরায় বলতে শুরু করে, ‘এই ইবলিশ করছিল কী হুনবেন? তার লগে পীড়িত আছিল মালেকের মাইয়া আয়েশার। আয়েশার বিয়া হইয়া যায় গেরামেরই অন্য এক পোলার লগে। হেই রাগে গেরামে মেলেটারি আইলে শাজাইন্যায় করল কি? সোয়ামীর বাড়ি লইয়া গিয়া ধরাইয়া দিল আয়েশারে। ঘরের ভেতর আটকাইয়া পাঁচ পাকসেনায় আয়েশারে জ্বিনা করতে করতে খুন কইরা ফ্যালল। বেবাকই ঘটল শাজাইন্যার চক্ষের সামনে। মাজাইন্যা নমরুদ হেই রাইতেই গেরাম ছাইড়া কই যে পলাইয়া গ্যাল, আর ফিরা আইল না দেশ স্বাধীনের বাদেও।' কাশেম মাস্টারের বক্তব্য শেষ হয়ে গেলে পুকুরের পানির মতো স্তব্ধ হয়ে যায় চায়ের দোকান। আমার চোখের সামনে থর থর কাঁপতে থাকে ঘন অন্ধকারের একটি রাত। বরফের মতো ঠাণ্ডা জমাট অন্ধকারের তলায় আমার চেতনার স্রোত ক্রমেই ডুবতে থাকে। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে ওঠলে দম নিতে নিতে কাশেম মাস্টারকে আমি বলি, 'মাস্টার সাহেব, আকবর আলীর যে ছেলে শাজাহান, সে-ই হচ্ছে ছমেদ আলীর ছেলে আবদুল মজিদ!' নিরুত্তর কাশেম মাস্টারের চোখের চশমা ঘোলাটে না দেখালেও লোকটি পাঞ্জাবির কোণ দিয়ে চশমা মুছতে থাকে। বারবার মোছে। বুঝি পৃথিবীর সব ধুলো তার চশমার কাঁচকে ঢেকে দিয়েছে। এক সময় নিচু গলায় আমাকে বলে, 'চলেন আমার লগে, পথে একটা কতাও আমারে জিগাইবেন না, চুপচাপ খালি পিছু পিছু হাঁটবেন।' ভিড় জমা কৌতূহলীদের হাতের ইশারায় সরে যেতে আদেশ করে কাশেম মাস্টার মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে। আমি তার অনুগামী। কাশেম মাস্টারের হাঁটা বা পা ফেলার গতি দেখে কেনো জানি আমার মনে পড়ছে জানাজার উদ্দেশ্যে মুর্দা কাঁধে হেঁটে যাওয়া মানুষের কথা। বাজার ছেড়ে কাঁচা সড়ক। তারপর গ্রাম্য আলপথ। আমরা দুজন হাঁটছি। একটি দীর্ঘ শূন্য ফসলের চাতাল পেরিয়ে যাই আমরা। তারপর লোকালয়। গাছ-গাছালি। বাঁশবন। গাছ-গাছালির গ্রাম পেরোতে থাকি আধঘণ্টা ধরে। এর মধ্যে কাশেম মাস্টার মাত্র একবার মাথা তুলে আকাশ দেখে নেয়। 

পুনরায় আনত হয় তার মাথা। এক সময় কাশেম মাস্টার টিনের ঘরের একটি বাড়ির উঠোনে এসে থামে। আমি দেখতে পাই মাটির কোঠার একটি ঘরের বারান্দায় এক বৃদ্ধা বসে আছে। কাশেম মাস্টার আকাশের দিকে চোখ তুলে অনুচ্চ গলায় বলতে থাকে, 'এ্যাইটা আমার বাড়ি। ওই যে বারান্দায় বইসা রইছে আমার আম্মা, আপনে যার খোঁজে আইছেন হেই আব্দুল মজিদেরও আম্মা, ছবিখান আম্মারে দ্যাখ্যান, চিনতে নি পারে তার হোড পুতেরে, তেত্রিশটা বছর পরে নি চিনতে পারে।' ঠাডার মড়ার মতো আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি। পৃথিবীর সব সত্য ও মিথ্যা হিংস্র জন্তুর মতো আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আত্মরক্ষার কোনও চেষ্টাই নেই আমার। আর তখনই কাশেম মাস্টার পুনরায় বলে, 'খাড়াইয়া রইছেন ক্যান? শহরে ফিরা যাইবেন না? জলদি করেন। আম্মারে তার ছোড় পোলার ছবিডা দ্যাহান।' মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর মতো আমি যেনো ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে এগোতে থাকি। বৃদ্ধার সামনে এলিয়ে পড়ে আমার হাত।


Thank You For The Post Store

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url